মন্ত্রঃ
দেড়যুগ আগের কথা। হিমালয়ের জটাজাল এলিয়ে পড়েছে কামাখ্যা পাহাড়ের কোলে। বিপাশা, শুকদেব, শতদ্রু বা কর্ণালী আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলো না। হিমালয়ের শতশত তীর্থপথের পথিক আমি পথে পথে পেয়েছি বাঁধা। পাই তাতে ক্লান্ত নই। আমি চাই আমার সেই বস্তু- যা অপ্রাপ্য বলে কথিত। কোলকাতার কালীঘাট, কেওড়াতলা, নিমতলা, কাশীপুর, শ্মশান ঘাট ধরে এই গঙ্গার তীরে শান্তিপুর, নবদ্বীপ, উদ্ধারণপুর ঘাটের মহাশ্মশানগুলিতে ঘুরলেম। দেখলেম বহু সাধক, সাদিকা, শ্মশানচারী শ্মশানচারীণী, ভৈরব-ভৈরবী- তারা দিলেন অনেক মন্ত্র-তন্ত্র-কবচ-যন্ত্র। কিন্তু তাদের ব্যবহার বিধি জানালেন না।তখনো তারাপীঠে যাই নি। সোজা গঙ্গার চড়াই ও উৎরাই দিয়ে পাটনা, বেনারস, এলাহাবাদ, হরিদ্বার। না-মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলো না। তবে হ্যাঁ- হরিদ্বারের চণ্ডীপাহাড়ে কোলো এক সাধুর স্নিগ্ধ আলিঙ্গন পেলেম। তিনি বললেন- “যা, তুই তারাপীঠে।” তার কথা শুনেওশুনিনি প্রথমে। পাঞ্জাব-হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর ঘুরে এলুম প্রয়াগে। সেখান থেকে বেনারস। তারপর একদিন তারাপীঠে। তারামায়ের চরণতলে দ্বারকানদীর চওড়া বালুচরে ক্যাকটাস্ গাছগুলি অসুর মুণ্ডের মতো ছড়িয়ে আছে। আর শ্মশানের পোড়া কাঠ, আধ্পোড়া অস্থি, করোটি নিয়ে দূরে দূরে ডেরা পেতেছেন তান্ত্রিকরা আউল-বাউল আর অঘোরপন্থীরা। সেখানে একদিন নিশীথ রাতে কার রুদ্রসুন্দর কণ্ঠসুরে আমার ধ্যানের জড়তা কাটলো।
“…………সিংহসনমনন্যধীঃ।
তত্র সংভাব্যতে শয্যা জ্ঞানানন্দস্বরুপিণী।।
শিবং তত্র বিভাব্যাথ সর্ব্বালঙ্কারভূষিতম্।
দিগম্বরং মহাকায়মুন্মত্তং কামভাবতঃ।
শয্যায়ামূর্দ্ধলিঙ্গঞ্চ ভাবয়েৎ সাধকাগ্রণীঃ।।
এ-কার কণ্ঠস্বর?
আসন থেকে উঠে পড়লুম। অন্ধকারে পথ চিনি না। সেই উদাত্ত কন্ঠস্বর যে আমার গতিপথকে চিনিয়ে দিচ্ছে। ঐ-ঐ যে দুটো জ্যোতি
জ্বলছে নিবিড় আঁধারে। সে দুটি জ্যোতি হল জ্যোতির্ময় সাধকের নেত্রদ্বয়। তিনি যে আমাকে কিছু বলবার জন্যই এই পাঠ করছেন। মাথানত করে দাঁড়ালেম তার সামনে। একটা ধুনি জ্বলছে। তার ম্লান আলোতে দেখলুম- কী জ্যোতিভরা মূর্তি তাঁর। বললেন,
“মন্ত্র জপ্ কর। মন্ত্র শেখা নর-নারীকে। সব ভাগ্যদোষ কেটে যাবে। আগে ধ্যান-পরে মন্ত্র। যা- যা।”
-কোথায় যাবো?
-কামাখ্যায়।
এই সেই কামাখ্যা।
এই সেই তন্ত্রের প্রাচীন পীঠস্থান।
এখানেই শিব সাধনা করেছেন। এখানে মীননাথ বন্দী হয়েছেন। এখানেই গোরক্ষনাথ যোগসাধনায় সিদ্ধি লাব করেছেন। এখানেই আমি এক মহাতান্ত্রিক বাবার মুকে শুন্লেম্-
“রক্তবস্ত্রাং বরোদ্যুক্তাং সিন্দুরতিলকান্বিতাম্।
নিষ্কলঙ্কাং সুধাধাম- বদনকম লোকজ্জ্বলাম্।।
স্বর্ণাদিমণি মাণিক্যভূষণৈভূষিতাং পরাম্।
নানারত্নাদি- নির্ম্মাণ- সিংহাসনোপরিস্থিতাম্।।
হাস্যবক্ত্রাং পদ্মরাগ- মণিকান্তিমনুত্তমাম্।
পীনোত্তুঙ্গ- কুচাং কৃষ্ণাং শ্রুতিমূল গতেক্ষণাম্।।
কটাক্ষৈশ্চ মহাসম্পদ্দায়িনীং হরমোহিণীম্।
সর্ব্বাঙ্গুসুন্দরীং নিত্যাং বিদ্যাভিঃ পরিবেষ্টিতাম্।।”
মনে হল এখানেই আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। এখানেই বেদ তন্ত্র-মন্ত্র সবের সার লাভ হবে। এখানেই জ্যোতিষ বিদ্যা শিক্ষা সার্থক হবে।
এখানেই এক ভৈরবী আমাকে শিক্ষা দেন। তাই এখানে ব্যক্ত করছি।তিনি বললেন, রত্ন-কবচ-যন্ত্র ও স্তোত্র পাঠ তন্ত্রেরই অঙ্গ এবং ঋগ্বেদ থেকে মহাভারত পর্যন্ত যে সব মন্ত্র ও স্তোত্র দেখতে পাও সবই বগবানের আশীর্বাদ পেতে হলে চাই তন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা। শোনা মহাভারতের বনপর্বে যুধিষ্ঠিরকে মার্কণ্ডেয় মুনি কার্তিক স্তোত্র শোনাচ্ছেন। আর এই স্তোত্র পাঠের কি কি ফল লাভ হয় তাও ব্যক্ত করেছেন।এবং এইসব গ্রহরা কার্তিকের অধীন। মহাভারতে তা পাওয়া যায়। মহাভারতে “পুরুষাশ্চৈব যে গ্রহাঃ”তা হল স্কন্দগ্রহ। এই পুরুষ গ্রহদের মন জয় করবার জন্য স্থানীয় দ্রব্য, ধূপ, কজ্জ্বল, বলিদান এবং অর্ঘ্য দিয়ে কার্তিকের পূজা করতে হয়। এবং কার্তিকের আদেশে এই সব গ্রহরা নরনারীর মঙ্গল, আয়ু ও বল বৃদ্ধি করে।
মহাভারতের বনপর্বে আরো বলা হয়েছে, “নরনারীর ষোড়শ বছর বয়স পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহরা তাদের অনিষ্ট করবার জন্য তৎপর থাকে। এবং ষোল বছর বয়সের পর পুরুষ গ্রহরা তাদের অমঙ্গল করাবার চেষ্টা করে। এই সব গ্রহকে বেদব্যাস কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন দেখো।
যে নরনারী জাগরিত অবস্থায় বা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেবতা দেখে ও সত্ত্বর উন্মত্ত হয় তখন জানবে দেবগ্রহ তাকে ভর করেছে।
আর জাতরিত বা ঘুমন্ত অবস্থায় যে পিতৃলোক দেখে তাকে পিতৃগ্রহ ভর করেছে।
যে লোক সর্বদা স্বপ্নের ঘোরে ভুল বকে তাকে সিদ্ধ গ্রহ ভর করেছে।
আর যে জাগ্রত অথবা ঘুম ভয়ের স্বপ্ন দেখে তাকে রাক্ষস গ্রহ বলেছেন।
এই সকল গ্রহদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ-
ক্রীড়াভিলাসী গ্রহ, ভোলাভিলাষী গ্রহ এবং কামাভিলাষী গ্রহ।
এই জন্য সংযত চিত্তে, ইন্দ্রিয়দমনশীল, পবিত্র, সদা আলস্যহীন আস্তিক ও মহাদেবের প্রতি আস্থাশীল হয়ে কার্তিকের পূজা করলে সব গ্রহ ভয় দূর হয়। প্রতি নর-নারীর উচিত কর্তিক যন্ত্র ধারণ করা।
মহাভারতে বনপর্বে মার্কণ্ডেয় মুনি যে “কার্তিক গাথা” গেয়েছেন তা সর্বদা মনে রাখবে।